টাইপ ২ ডায়াবেটিস, যেখানে শরীর পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না অথবা ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। হাইপোক্যালেমিয়া হলো রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া। রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা 3.৫ থেকে ৫.৫ মিলি মোলস প্রতি লিটারে থাকার কথা। তার কম এবং বেশি মাত্রা দুটোই বিপজ্জনক। বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে, হাইপোক্যালেমিয়া ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।
রক্তে পটাসিয়াম কমে যাওয়ার একটি কমন অবস্থা আপনারা জানেন – ডাইরিয়া। তাতে ORS (ইলেক্ট্রোরাল) দেওয়া হয় (যাতে পটাসিয়াম ক্লোরাইড সল্ট থাকে)। ডাইরিয়া রোগী নেতিয়ে পড়ার একটা কারণ রক্তে পটাসিয়াম কমে যাওয়া। আমরা এই নেতিয়ে যাওয়া অবস্থাকে বলি শক। অনেক সময়ে খুব গরমের সময়ে তাপ প্রবাহে একই অবস্থা হয়। শক খুবই বিপজ্জনক অবস্থা এবং সিরিয়াস অবস্থা হলে ICU ছাড়া রোগী কে বাঁচানো কঠিন হয়।
ডায়াবেটিক রুগীর শক মতো অবস্থা হলে নিজেরা বাড়িতে ORS দেবেন না। রক্তে শর্করার মাত্রা অনেক বেড়ে কিছু রোগীর ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস বা হাইপার অস্মলার নন কিটোটিক কোমা হয়। তাতেও বার বার পায়খানা, বমি হয়। ORS এ শর্করা থাকার কারণে আমরা অবস্থা বিচার করে চিকিৎসা করি। ORS (ইলেক্ট্রোরাল) তৈরী করা ডাইরিয়া, তাপ প্রবাহ ইত্যাদির জন্য। ডায়াবেটিক রুগীদের ORS দিতে ডাক্তারের পরামর্শ আবশ্যক।
পটাশিয়াম এবং শরীরের কার্যক্রমে ভূমিকা
পটাশিয়াম হলো একটি অপরিহার্য ইলেকট্রোলাইট যা কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম, নার্ভ সংকেত প্রেরণ এবং পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও, এটি ইনসুলিন নিঃসরণ ও শর্করার বিপাকের সাথে জড়িত।
পটাশিয়াম কমলে অর্থাৎ হাইপোক্যালেমিয়া হলে কি হয়
মৃদু হাইপোক্যালেমিয়া সাধারণত উপসর্গবিহীন হয়, যদিও এটি রক্তচাপ বৃদ্ধি করতে পারে এবং অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের বিকাশ ঘটাতে পারে। তীব্র হাইপোক্যালেমিয়াতে পেশির দুর্বলতা, পেশি ব্যথা (মায়ালজিয়া), কাঁপুনি এবং পেশির টান ধরার (ক্র্যাম্প) কারণ হতে পারে – যা পেশির কার্যক্রমে বিঘ্নের জন্য ঘটে। একই সঙ্গে, মসৃণ পেশির কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায় কোষ্ঠকাঠিন্যও দেখা দিতে পারে।
আরও তীব্র হাইপোক্যালেমিয়ার ক্ষেত্রে, পক্ষাঘাত (flaccid paralysis) এবং রিফ্লেক্সের ঘাটতি (hyporeflexia) দেখা দিতে পারে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, কঙ্কাল পেশির কার্যক্ষমতার মারাত্মক ব্যাঘাতের কারণে শ্বাসপ্রশ্বাসে অবসাদ (respiratory depression) দেখা দিতে পারে। তীব্র হাইপোক্যালেমিয়ার সাথে মানসিক উপসর্গ যেমন বিভ্রান্তি (delirium), বিভ্রম (hallucination) অথবা মনোব্যাধি (psychosis) দেখা দিতে পারে।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে হাইপোক্যালেমিয়ার কারণসমূহ
- ইনসুলিন থেরাপি: ইনসুলিন রক্তে পটাশিয়ামকে কোষে স্থানান্তর করতে সাহায্য করে। ফলে ইনসুলিন গ্রহণের ফলে রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ কমে যেতে পারে।
- ডাইউরেটিক ওষুধ: অনেক টাইপ ২ ডায়াবেটিক রোগী উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থায়াজাইড বা লুপ ডাইউরেটিক গ্রহণ করেন, যা কিডনির মাধ্যমে অতিরিক্ত পটাশিয়াম বের করে দেয়।
- অসুস্থ কিডনি কার্যক্রম: টাইপ ২ ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে কিডনি আক্রান্ত হতে পারে, যার ফলে ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।
- অতিরিক্ত প্রস্রাব (পলিউরিয়া): ডায়াবেটিসের কারণে অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়ার ফলে শরীর থেকে পটাশিয়াম দ্রুত বেরিয়ে যায়।
হাইপোক্যালেমিয়ার ডায়াবেটিসের উপর প্রভাব
ইনসুলিন নিঃসরণ হ্রাস: কম পটাশিয়াম ইনসুলিন নিঃসরণ কমিয়ে দেয়, যা গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে তোলে।
ইনসুলিন প্রতিরোধ বৃদ্ধি: হাইপোক্যালেমিয়া কোষে ইনসুলিন রিসেপ্টরের প্রতিক্রিয়া কমাতে পারে, ফলে ইনসুলিন কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
হৃদয়জনিত ঝুঁকি: ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে হাইপোক্যালেমিয়া হৃদস্পন্দনের অস্বাভাবিকতা এবং হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রতিকার এবং ব্যবস্থাপনা
নিয়মিত পটাশিয়াম মনিটরিং: ডায়াবেটিক রোগীদের বিশেষ করে যারা ইনসুলিন বা ডায়রেটিক গ্রহণ করেন, তাদের রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।
পুষ্টিগত সমর্থন: পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাদ্য যেমন কলা, কমলা, আলু, পালং শাক ইত্যাদি গ্রহণে উপকার হয়।
প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পটাশিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা যেতে পারে।
ড্রাগ ব্যবস্থাপনার পুনর্মূল্যায়ন: প্রয়োজনে ওষুধ পরিবর্তন বা মাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধি করা দরকার হতে পারে।
উপসংহার
হাইপোক্যালেমিয়া এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মধ্যে সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল চ্যালেঞ্জ। রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট আরও কার্যকর হতে পারে। তাই চিকিৎসক, রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের এই বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।