ক্যালসিয়াম মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খনিজ উপাদান। এটি শুধুমাত্র হাড় এবং দাঁত মজবুত রাখার জন্য নয়, বরং পেশী সংকোচন, স্নায়ু সঞ্চার, রক্ত জমাট বাঁধা এবং হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণের জন্যও অপরিহার্য। অথচ, ভারতে ক্যালসিয়াম ঘাটতির সমস্যা দিনে দিনে বাড়ছে এবং এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য এক গোপন বিপদের রূপ নিচ্ছে।
ভারতে ক্যালসিয়ামের ঘাটতির চিত্র
ভারতীয় পুষ্টি জরিপ এবং বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী প্রতিদিনের ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারছে না। বিশেষ করে শিশু, কিশোর-কিশোরী, গর্ভবতী নারী, দুগ্ধদানকারী মায়েরা এবং বয়স্কদের মধ্যে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি অনেক বেশি দেখা যায়।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (NFHS) এবং ICMR-এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে গড়ে ৭০%-এর বেশি মানুষ দৈনন্দিন ক্যালসিয়ামের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে অক্ষম। গ্রামীণ অঞ্চলে এই হার আরও বেশি। শহরাঞ্চলেও অতি ব্যস্ত জীবনধারা ও অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসের কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
ক্যালসিয়াম ঘাটতির কারণসমূহ
ভারতে ক্যালসিয়াম ঘাটতির পিছনে একাধিক কারণ কাজ করে:
- দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণের অভাব: অনেক ভারতীয় পরিবার অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বা খাদ্যাভ্যাসগত কারণে পর্যাপ্ত দুধ, দই, ছানা ইত্যাদি গ্রহণ করে না।
- ভেজান খাদ্যাভ্যাস: অনেক ভারতীয় নিরামিষাশী হওয়ায় প্রোটিন ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা যায়, কারণ প্রাণিজ উৎস থেকে সহজে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়।
- ভিটামিন ডি-এর অভাব: ভিটামিন ডি দেহে ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে। ভারতে প্রচুর রোদ থাকা সত্ত্বেও আধুনিক জীবনধারার কারণে অনেকেই পর্যাপ্ত সূর্যালোক পান না, ফলে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি ঘটে।
- দূষণ ও খাদ্যদ্রব্যের মানহানি: কৃষিজমির পুষ্টিগুণ হ্রাস এবং রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে খাদ্যে খনিজের পরিমাণ কমে গেছে।
- জাঙ্ক ফুড ও প্রসেসড খাদ্যের প্রভাব: পুষ্টিকর খাদ্যের পরিবর্তে ফাস্ট ফুড, কার্বনেটেড ড্রিঙ্কস এবং প্রসেসড খাবারের প্রচলন ক্যালসিয়াম হ্রাসের অন্যতম কারণ।
- কিছু রোগব্যাধি: হাইপারপ্যারাথাইরয়েডিজম, কিডনি রোগ এবং কিছু অন্ত্রজনিত রোগ ক্যালসিয়াম শোষণ বাধাগ্রস্ত করে।
ক্যালসিয়াম ঘাটতির লক্ষণ ও উপসর্গ
ক্যালসিয়ামের ঘাটতি প্রথমদিকে খুব স্পষ্ট না হলেও ধীরে ধীরে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে:
- হাড়ের দুর্বলতা এবং ভঙ্গুরতা (অস্টিওপোরোসিস)
- দাঁতের দুর্বলতা বা অকাল ক্ষয়
- মাংসপেশীর ব্যথা ও সংকোচন
- হাত-পা ঝিঁঝি ধরা বা অসাড় অনুভূতি
- হৃদস্পন্দনের অনিয়ম
- মানসিক অবসাদ ও স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা
শিশুদের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম ঘাটতি তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, এমনকি রিকেটস-এর মতো হাড়ের রোগও দেখা দিতে পারে।
সম্পর্কিত প্রবন্ধ পড়ুন : ভারতে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতির গুরুত্ব
প্রতিরোধ ও করণীয়
ভারতে ক্যালসিয়াম ঘাটতি রোধ করতে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক উভয় স্তরে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি:
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন
- প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ, দই, ছানা, পনির ইত্যাদি গ্রহন করা।
- পালং শাক, মেথি, ব্রোকলি, বাদাম (বিশেষ করে কাজু বাদাম, চিনে বাদাম এবং আখরোট), তিল ইত্যাদি খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা।
- সামুদ্রিক মাছ, বিশেষ করে ছোট মাছ (যেমন শুঁটকি মাছ), ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস
- ফোর্টিফায়েড খাবার (যেমন ফোর্টিফায়েড দুধ ও সিরিয়াল) বেছে নেওয়া।
- পর্যাপ্ত সূর্যালোক গ্রহণের জন্য দিনে অন্তত ২০–৩০ মিনিট বাইরে থাকা।
চিকিৎসক পরামর্শ
- প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সম্পূরক গ্রহণ করা।
- নিয়মিত হাড়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা (BMD টেস্ট) করা, বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা প্রচারাভিযান চালানো দরকার যাতে সাধারণ মানুষ খাদ্য ও জীবনধারার গুরুত্ব বোঝে এবং ছোটবেলা থেকেই পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য পুষ্টি-শিক্ষা কর্মসূচি আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
উপসংহার
ভারতের মতো দেশে, যেখানে জনসংখ্যা বিপুল এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য প্রবল, ক্যালসিয়াম ঘাটতি একটি নীরব স্বাস্থ্যঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সমস্যা নিরসনে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি নীতি-পর্যায়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। আজ সচেতন উদ্যোগ নিলে আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ, সবল এক ভারত গড়ে তোলা সম্ভব।