ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (DKA) একটি গুরুতর এবং প্রাণঘাতী জটিলতা, যা সাধারণত টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে দেখা যায়। তবে এটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যেও ঘটতে পারে, বিশেষত যখন ইনসুলিনের চাহিদা বেড়ে যায় অথবা ইনসুলিন থেরাপি পর্যাপ্ত না হয়। এটি একটি চিকিৎসা জরুরি অবস্থা, এবং সময়মত সনাক্ত ও চিকিৎসা না করলে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে।
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস কী?
DKA ঘটে যখন শরীর ইনসুলিনের ঘাটতির কারণে শর্করা ব্যবহার করতে না পেরে ফ্যাট ভাঙতে শুরু করে শক্তি উৎপাদনের জন্য। ফ্যাট ভাঙার ফলে কিটোন নামক অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ তৈরি হয়, যা রক্তে জমা হতে থাকে। এই কিটোনের মাত্রা বেড়ে গেলে রক্তের অম্লতা (অ্যাসিডিটি) বেড়ে যায় এবং তা DKA তৈরি করে।
কারণসমূহ
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিসের প্রধান কারণ হলো ইনসুলিনের ঘাটতি। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণ ও পরিস্থিতি এই জটিলতাকে ট্রিগার করতে পারে:
- ইনসুলিন থেরাপির অনিয়ম বা বন্ধ হয়ে যাওয়া
- নতুনভাবে ডায়াবেটিস নির্ণয় হওয়া কিন্তু চিকিৎসা শুরু না করা
- ইনফেকশন (যেমন নিউমোনিয়া, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন)
- তীব্র মানসিক চাপ বা শারীরিক ট্রমা
- হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক
- কিছু ওষুধ গ্রহণ (যেমন স্টেরয়েড)
উপসর্গসমূহ
DKA-এর উপসর্গগুলো ধীরে ধীরে শুরু হয়ে তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা যায়:
- অতিরিক্ত পিপাসা ও ঘন ঘন প্রস্রাব
- বমি বমি ভাব বা বমি
- পেট ব্যথা
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা গভীর এবং দ্রুত শ্বাস (Kussmaul respiration)
- মুখে ফলের গন্ধের মতো গন্ধ (Acetone breath)
- বিভ্রান্তি বা অচেতনতা
রোগ নির্ণয়
DKA নির্ণয়ের জন্য নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলো করা হয়:
- রক্তে শর্করার মাত্রা (সাধারণত >250 mg/dL)
- রক্তে কিটোন মাত্রা (ইউরিন কিটোন বা বেটা-হাইড্রোক্সিবিউটিরেট) বেশি থাকে
- আর্টেরিয়াল ব্লাড গ্যাস (ABG) – অ্যাসিডোসিস আছে কিনা বুঝতে করা হয়
- ইলেকট্রোলাইট লেভেল (পটাশিয়াম, সোডিয়াম) দেখা হয়
- রেনাল ফাংশন টেস্ট (ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া) করা হয়
- CBC ও ইনফেকশন স্ক্রীনিং করা হয়
চিকিৎসা
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো ইনসুলিনের মাধ্যমে কিটোন উৎপাদন বন্ধ করা, ডিহাইড্রেশন সারানো এবং ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখা।
সাধারণত IV স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয় (0.9% NaCl)। এটি ডিহাইড্রেশন এবং রক্তে শর্করা কমাতে সহায়তা করে।
IV ইনসুলিন দেওয়া হয় কিটোন উৎপাদন বন্ধ করতে এবং শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখতে। রক্তে শর্করা ২০০ mg/dL এর নিচে এলে ইনসুলিনের মাত্রা অ্যাডজাস্ট করা হয়।
বিশেষ করে পটাশিয়ামের মাত্রা পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনে পরিবর্তন করা হয়। ইনসুলিন থেরাপির কারণে পটাশিয়াম দ্রুত কমে যেতে পারে। ইনফেকশন থাকলে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
প্রতিরোধ ও সচেতনতা
- DKA প্রতিরোধের জন্য রোগী এবং তার পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহণ নিশ্চিত করা
- অসুস্থ হলে শর্করা ও কিটোন মনিটর করা
- যথাসময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
- ডায়াবেটিস সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ
উপসংহার
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস একটি বিপজ্জনক অবস্থা হলেও সঠিক জ্ঞান, সময়মতো সনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই রোগ সম্পর্কিত জটিলতা সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত প্রয়োজন।