আয়রন স্বল্পতাজনিত রক্তাল্পতা (Iron Deficiency Anaemia) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন না থাকায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যায়। এটি বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যেখানে অপুষ্টি, দারিদ্র্য, এবং খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণে অনেক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন।
আয়রনের ভূমিকা ও হিমোগ্লোবিনের গুরুত্ব
আয়রন হিমোগ্লোবিন গঠনের একটি অপরিহার্য উপাদান, যা লোহিত রক্তকণিকায় (RBC) উপস্থিত থাকে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পরিবহন করে। যখন শরীরে পর্যাপ্ত আয়রন থাকে না, তখন পর্যাপ্ত পরিমাণে হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না, যার ফলে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যাহত হয় এবং ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
ভারতীয় উপমহাদেশে আয়রন স্বল্পতার কারণ
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোতে আয়রন স্বল্পতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- অপুষ্টি ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস
- ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক মানুষ দৈনিক খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রনযুক্ত খাবার গ্রহণ করেন না।
- নিরামিষাশী খাদ্যাভ্যাসে হেম আয়রনের (যা প্রাণীজ উৎস থেকে আসে) অভাব দেখা যায়।
- শাকসবজি, ডাল ও শস্যজাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকলেও এগুলোর মধ্যে থাকা ফাইটেট ও অক্সালেট উপাদান আয়রনের শোষণ ব্যাহত করতে পারে।
কুলেখাড়া (Hygrophila spinosa) আয়রন স্বল্পতাজনিত রক্তাল্পতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে পরিচিত। এটি প্রাকৃতিকভাবে আয়রনের একটি সমৃদ্ধ উৎস এবং রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সহায়ক। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলায় কুলেখড়ার পাতা ও রস দীর্ঘদিন ধরে রক্তস্বল্পতার প্রাকৃতিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই উদ্ভিদ লোহিত রক্তকণিকার উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং শরীরে অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে, যা রক্তাল্পতা কমাতে কার্যকর।
- রক্তক্ষরণজনিত কারণ
- মহিলাদের মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ (Menorrhagia)।
- গর্ভাবস্থায় আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া।
- পরজীবী সংক্রমণ (যেমন: হুকওয়ার্ম ইনফেকশন), যা অন্ত্রে রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে।
- দারিদ্র্য ও অশিক্ষা
- অনেক মানুষ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারেন না।
- অশিক্ষার কারণে অনেকে আয়রনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন নন।
- কিছু নির্দিষ্ট রোগ
- পাকস্থলি ও অন্ত্রের সমস্যার কারণে (যেমন: গ্যাস্ট্রিক আলসার, ইনফ্লেমেটরি বোয়েল ডিজিজ) শরীরের আয়রন শোষণ কমে যায়।
- দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ বা কিডনির রোগ থাকলে শরীরের আয়রন শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
আয়রন স্বল্পতাজনিত রক্তাল্পতার লক্ষণ
- দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি ও দুর্বলতা
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
- শ্বাসকষ্ট
- মাথাব্যথা ও মাথা ঘোরা
- হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়া
- চুল পড়া ও নখ ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া
- খাওয়ার অদ্ভুত অভ্যাস (যেমন: মাটি বা বরফ খাওয়ার ইচ্ছা, যা ‘Pica’ নামে পরিচিত)
পরীক্ষা ও নির্ণয়
ডায়গনোসিসের জন্য নিম্নলিখিত পরীক্ষাগুলি করা হতে পারে:
- CBC (Complete Blood Count): হিমোগ্লোবিন ও লোহিত রক্তকণিকার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়।
- Serum Ferritin Test: শরীরে আয়রনের মজুত পরিমাণ বোঝার জন্য এই পরীক্ষা করা হয়।
- Serum Iron & TIBC Test: রক্তে আয়রনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
- Stool Test: অন্ত্রের রক্তক্ষরণ আছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্য করা হয়।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
- খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন
আয়রনসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত:
- প্রাণীজ উৎস: লিভার, লাল মাংস, মাছ, ডিম।
- উদ্ভিদজাত উৎস: পালংশাক, কলাই, ছোলা, রাজমা, বাদাম, আখরোট।
- ভিটামিন C-সমৃদ্ধ খাবার (লেবু, কমলা, আমলকি) আয়রনের শোষণ বৃদ্ধি করতে সহায়ক।
- চা ও কফি কম খাওয়া উচিত, কারণ এগুলো আয়রন শোষণে বাধা সৃষ্টি করে।
- আয়রন সাপ্লিমেন্ট: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট বা সিরাপ গ্রহণ করা যেতে পারে। গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মহিলাদের জন্য নিয়মিত আয়রন সম্পূরক গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
- সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
- পরজীবী সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করা।
- অন্ত্রের রক্তক্ষরণজনিত সমস্যাগুলোর জন্য পরামর্শ নেওয়া।
- স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি
- শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
- গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
উপসংহার
ভারতীয় উপমহাদেশে আয়রন স্বল্পতাজনিত রক্তাল্পতা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য ও চিকিৎসাযোগ্য। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সচেতনতার মাধ্যমে এই সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব।
আরও পড়ুন: ভিটামিন B12 এবং ফলেট স্বল্পতাজনিত রক্তাল্পতা
Ref for কুলেখড়া (Hygrophila spinosa): [1] https://www.researchgate.net/figure/EFFECT-OF-KULEKHARA-ON-HEMOGLOBIN-TOTAL-RBC-COUNT-AND-PCV_tbl1_282185494
[2] https://www.ijsr.net/archive/v6i2/ART2017752.pdf